উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানে সামরিক বাহিনীর সাথে দেশটির আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-র সংঘর্ষ চলছে এবং এর মধ্যেই দেশটিতে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে হামলার শিকার হয়েছেন।
হামলায় রাষ্ট্রদূত গুরুতরভাবে আহত হননি বলে জানা গেছে। ১৮ এপ্রিল (মঙ্গলবার) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদানে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত আইদান ও’হারা দেশটির রাজধানী খার্তুমে তার বাসভবনে হামলার শিকার হয়েছেন। তবে আইরিশ এই কূটনীতিক ‘গুরুতরভাবে আহত হননি’ বলে আইরিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন নিশ্চিত করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন এই হামলাকে ‘কূটনীতিকদের সুরক্ষা সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতার চরম লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছেন।
জাতিসংঘের মতে, গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া প্রথম তিন দিনের লড়াইয়ে সুদানে প্রায় ১৮৫ জন নিহত এবং ১৮০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। দুই বাহিনীর মধ্যকার এই সংঘর্ষে রাজধানী খার্তুমে বিমান হামলা, আর্টিলারি এবং ভারী গোলাগুলির ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম বলছে, সুদানের সেনাবাহিনী এবং কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-র মধ্যে ক্ষমতার লড়াই দেশটিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। রাজধানী খার্তুমে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল বলে পরিচিত সুদানের রাজধানীতে এই লড়াই নজিরবিহীন এবং এমনকি এটি বেশ দীর্ঘায়িতও হতে পারে। যদিও আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকভাবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে কূটনীতিকরা সক্রিয় হতে শুরু করেছেন।
অবশ্য সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামে ওই আধাসামরিক বাহিনী উভয়ই খার্তুমের প্রধান প্রধান স্থাপনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দাবি করছে। তবে সেখানে এখনও জোরালো সংঘর্ষ চলছে এবং বাসিন্দারা বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
আইরিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন খার্তুমে হামলার শিকার রাষ্ট্রদূত আইদান ও’হারাকে ‘অসামান্য আইরিশ এবং ইউরোপীয় কূটনীতিক হিসাবে অভিহিত করে বলেছেন, তিনি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও ইইউকে সেবা করছেন’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তার সেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই এবং সুদানে সহিংসতা বন্ধ করার ও সংলাপ পুনরায় শুরু করার জন্য আহ্বান জানাই।’
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেল এক টুইট বার্তায় বলেন, কূটনৈতিক প্রাঙ্গণ এবং কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সুদানের কর্তৃপক্ষের ‘প্রাথমিক দায়িত্ব’।
ইইউর মুখপাত্র নাবিলা মাসরালি বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, হামলার পর ইইউ প্রতিনিধি দলকে খার্তুম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়নি। কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে অগ্রাধিকার রয়েছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, চলমান নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং খার্তুমের বিমানবন্দর বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে মার্কিন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই।
তবে তিনি (সুদানে অবস্থানরত) সকল আমেরিকানকে ‘অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে’ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে চলা-ফেরা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবিসি বলছে, সুদানের রাজধানীতে এই লড়াই নজিরবিহীন এবং এমনকি এটি বেশ দীর্ঘায়িতও হতে পারে। আর তাই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের আশঙ্কার মধ্যে সুদানের অনেক বেসামরিক নাগরিক তাদের বাড়িতে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া চলমান এই সংঘাত আফ্রিকার এই দেশটিকে গভীর বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে সোমবার খার্তুমের প্রধান বিমানবন্দরের ওপরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। এমনকি টিভিতে আগুন এবং বিস্ফোরণের ছবিও দেখানো হয়েছে। আরএসএফ-এর ঘাঁটি লক্ষ্য করে সেনাবাহিনীর বিমান হামলা চলছে। এছাড়া আরএসএফ-এর কিছু ঘাঁটি আবাসিক এলাকায় রয়েছে বলেও জানা গেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতেও হামলা করা হয়েছে। এছাড়া অন্য দু’টি ক্লিনিকসহ খার্তুমের আল-শাব টিচিং হাসপাতালে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
সুদানের ডাক্তারদের ইউনিয়ন সতর্ক করেছে, লড়াইয়ের কারণে খার্তুম এবং অন্যান্য শহরের একাধিক হাসপাতাল ‘ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। এর মধ্যে কিছু শহরের চিকিৎসা সেবা সম্পূর্ণ ‘পরিষেবার বাইরে’ রয়েছে বলেও জানানো হয়।
সুদানে জাতিসংঘের মিশনের প্রধান ভলকার পার্থেস রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে নিরাপত্তা পরিষদকে বলেছেন, চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮৫ জন নিহত এবং আরও ১৮০০ জন আহত হয়েছেন। বৈঠকের পর পার্থেস সাংবাদিকদের বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি খুবই অস্পষ্ট। তাই লড়াইয়ের ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য কোথায় স্থানান্তরিত হচ্ছে তা বলা খুব কঠিন।’
এর আগে সোমবার জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সুদানের যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে ‘অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধ করার’ আহ্বান জানান। তিনি সতর্ক করে বলেন, লড়াইয়ের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেলে তা ‘দেশ ও অঞ্চলের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে।’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির সেনাবাহিনী। এরপর থেকে সেনাবাহিনীর জেনারেলরা ‘স্বাধীন কাউন্সিল’-এর নামে দেশ পরিচালনা করছিলেন।
এই স্বাধীন কাউন্সিলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হলেন জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো। অপরদিকে স্বাধীন কাউন্সিলের প্রধান হলেন জেনারেল আব্দেল ফাতাহ আল-বুরহান।
বেসামরিক সরকার গঠনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এই বিষয়টি নিয়েই সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
সেনাবাহিনী বলছে, আরএসএফকে দুই বছরের মধ্যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা হবে। কিন্তু আরএসএফ বলছে, এই একীভূতকরণের প্রক্রিয়া যেন অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরএসএফকে একীভূত করলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব কে দেবে এ নিয়েও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
আরএ