ঢাকা, এপ্রিল ১৭, ২০২৩ : কাগজে কলমে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও কারখানার বর্জ্যে তা প্রতিনিয়তই দুষিত হচ্ছে উচ্চমাত্রা হারে। এতে করে দিনকে দিন কমে যাচ্ছে মাছের প্রজনন। যার ফলে নদী-খাল বিলের মাছের বংশ বৃদ্ধিতে ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় এ রকম চিত্রই দেখা গেছে সম্প্রতি। এ মাসের শুরুর দিকে চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে পানি দূষণে জাটকাসহ নির্বিচারে মারা পড়ত দেখা গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ জলজ প্রাণী। বিশেষ করে মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল ইউনিয়নের বাবু বাজার এলাকার মেঘনা নদীর তীরে এর মাত্রা দেখা গেছে উল্লেখজনক হারে। এছাড়াও মেঘনার পানি দূষণের ফলে বাবু বাজার, ইস্পাহানির চর, গজারিয়া, ষাটনল, সটাকি, মহনপুর, এখলাসপুরসহ প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে নদীর সকল মাছ মরে ভেসে উঠেছে তীরে। জাটকা, পোয়া, বেলে, চেউয়া, চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নদীতে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনাসহ বেঁচে নেই কোনো জলজ প্রাণী। নদীর তীরে পড়ে থাকা এসম মাছ পচে, গলে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে। দুগন্ধের পাশাপাশি কালচে বর্ণ ধারণ করে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে নদীর পানি।
মতলব উত্তর উপজেলার বাবু বাজার এলাকার জেলে রতন দাস বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য মেঘনা নদীতে ছড়িয়ে পড়ায় নদীতে থাকা সব মাছ মরে তীরে ভেসে উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে শতশত মানুষ মৃত মাছ সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক মাছ নদীর তীরে পচে গন্ধ চড়াচ্ছে। কাক, চিল খাচ্ছে এসব মাছ। সরকার ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অথচ পানি পচে গিয়ে জাটকাসহ সকল মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এখন নিষেধাজ্ঞা শেষে আমরা কী ধরবো নদীতে!
আরেক জেলে শীতল বর্মণ বলেন, বেশ কয়েক বছর যাবত শীতের মৌসুমে নিয়মিতভাবে মেঘনার পানি দূষণের শিকার হচ্ছে। বর্ষার মৌসুমে নদীর পানি বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত থাকে এর স্থায়ীত্ব। ক্রমশ দূষণের তীব্রতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ছড়াচ্ছেও বেশি। এভাবে চলতে থাকলে ইলিশসহ কোনো মাছই থাকবে না নদীতে। আর নদীতে মাছ না থাকলে আমরা ধরবটা কী, খাবই বা কী? আমাদের দাবি যে করেই হোক এই দূষণ বন্ধে অচিরেই সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।
পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে মৎস্য বিজ্ঞানীরাও প্রাথমিক পর্যায়ে এর সত্যতা পেয়েছেন। তারা বলছেন, নদী দূষণ বন্ধ করা না গেলে আগামীতে মেঘনায় ইলিশসহ সব মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মেজবাবুল আলম বলেন, দূষণের কারণে পানিতে অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় মাছ মরে যাচ্ছে।
পানি দূষণের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে কল-কারখানার বর্জ্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা। উচ্চতর পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে দূষণের মূল কারণ জানা যাবে বলে জানান তিনি। তবে সহসায় দূষণরোধে স্থায়ী সমাধান না করা গেলে চাঁদপুরে ইলিশের উৎপাদন ব্যহত হবে বলে মনে করছেন তিনি।
বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আগেই মাছের অন্যতম প্রাকৃতিক ভাণ্ডার মেঘনা নদী দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন এমনটাই প্রত্যাশা জেলে পল্লীর বাসিন্দাদের। এতে করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি বেঁচে থাকবে তাদের জীবিকা আহরণের উৎসটি।
অন্যদিকে ঢাকার অদুরে সাভারে নয়ারহাটের বংশী নদীতেও দেখা গেছে একই অবস্থা। একসময় এখানকার জেলেরা সারাবছর নদীটির মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল থাকতে দেখা গেলেও এখন তা আর চোখে পড়ে না। এর কারণ হিসেবে জেলে মোহন রায় জানান, নদী দূষণের ফলে এখন আর নদীতে মাছ পাওয়া যায়না। কলকারখানার বর্জ্য আর নানারকম আবর্জনা জমে জমে নদীটি এখন আর নদী নেই। তাই ১২ মাসের মধ্যে ১০ মাসই অন্যকাজ করে জীবন ধারণ করতে হয়। শুধু বর্ষার মৌসুমে নদীটিতে কিছু মাছ ধরা হয় বলেও জানান এই জেলে।
নদী ও খালের পানি দূষিত হওয়ায় শুধু তিনিই না, সাভারের হাজারো জেলেকে একই সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
সাভার উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় জেলের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। বছরে শুধু শ্রাবণ ও ভাদ্র এই ২ মাস জেলেরা নদী ও খালে মাছ ধরতে পারেন।
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় নদীর সংখ্যা ৩টি ও সরকারি খাল ১৮টি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাভারের কোনো নদী বা খাল দূষণমুক্ত হয়নি।
মহাদেব রাজবংশী বলেন, 'এক সময় আমরা নদীতে মাছ ধরেই চলতাম। কলকারখানার বর্জ্যে পানি দূষিত হওয়ায় নদীতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। জেলে সম্প্রদায়ের অনেকে পেশা বদল করছে।'
নদী-খাল দূষণ বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলেও জানান তিনি।
'সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করলে আমাদের উপকার হতো। কিন্তু, আমরা কোনো সহায়তা পাই না,' বলেন মহাদেব।
বংশীর নামাবাজার এলাকায় গত ১০ বছর ধরে খেয়া পারাপার করেন আবেদ আলী। তিনি বলেন, 'এক সময় নদীর পানি পরিষ্কার ছিল। সেই পানি দিয়ে রান্না করা হতো। এখন বছরের অন্তত ৮ মাস নদীর পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। খেয়া পারাপারের সময় অসুবিধা হয়। দুর্গন্ধের কারণে নদীতে গোসল করা যায় না।'
নদী-খালের পানি দূষিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাভার উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, 'সাভারে জেলেদের অবস্থা বেশ করুণ। বছরে ২ মাস তারা নদী-খালে মাছ ধরতে পারেন।'
'আমি নিজেও সাভারের বংশী, ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদীসহ বেশ কয়েকটি খাল পরিদর্শন করেছি। দেখেছি নদীর পানি আর নর্দমার পানির মধ্যে পার্থক্য নেই। পানির যে অবস্থা তাতে মাছ কেন, কোনো জলজ প্রাণীই এখানে টিকে থাকতে পারে না,' যোগ করেন তিনি।
কামরুল ইসলাম বলেন, 'গত ২ মাস আগে তুরাগে ২টি গাঙ্গেয় ডলফিন মরে ভেসে উঠেছিল। ধারণা করছি, দূষিত পানির কারণেই ডলফিন ২টি মারা গেছে।'
নদী ও খালের পানিতে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি যেন নদী-খালে ফেলা না হয় সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার উপপরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, 'দূষণ বন্ধে আমরা নিয়মিতই কারখানা পরিদর্শন করি এবং শিল্পকারখানা কর্তৃপক্ষকে অনেক সময় দূষণের দায়ে জরিমানা করি।'
নিয়মিত মনিটরিংয়ের পরও নদীর পানি দূষিত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ট্যানারি শিল্পের বাইরেও সাভারে ডায়িং কারখানা আছে প্রায় ১২০টি এবং ওয়াশিং কারখানা রয়েছে ৬০টি। কারখানা খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা আর আমরা মনিটরিং করতে পারি ৮ ঘণ্টা। এ ছাড়া, আমাদের জনবলও অনেক কম।'
'আমরা পরিদর্শনের সময় তারা সিইটিপি চালায় এবং আমরা চলে এলে তাদের অনেকেই হয়ত তা চালায় না। সে কারণে নদী ও খালের পানি দূষিত হচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি,' বলেন জহিরুল ইসলাম তালুকদার।