হিরো আলমকে নিয়ে সমাজের ওপরতলার মানুষের তাচ্ছিল্যের শেষ নেই। এই চেহারা নিয়ে সে কীভাবে নায়ক হয়? এই কণ্ঠ নিয়ে কীভাবে গান গায়? বিশেষ করে তাঁর রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার ডিভিও ভাইরাল হওয়ার পর শহরের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে এমন শোরগোল চরমে ওঠে। গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে ডেকে নিয়ে যায় কার্যালয়ে। সেখানে তাঁর চেহারা ও বেশভূষা নিয়ে অপমান করা হয়, রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত গাওয়ার জন্য শাসানো হয় এবং আর গান না গাওয়ার ও সিনেমায় পুলিশের পোশাক না পরার মুচলেকা নেওয়া হয়।
যেকোনো উন্নত দেশে এমন লাঞ্ছনাকর ঘটনা ঘটলে নিন্দার ঝড় বয়ে যেত, সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরি খোয়াতে হতো, এমনকি এ জন্য জেল–জরিমানাও হতে পারত। আমাদের দেশের আইন ও সংবিধান অনুসারেও পুলিশের এ আচরণ ছিল অগ্রহণযোগ্য। এটি ছিল সংবিধান অনুসারে নির্যাতনের সমতুল্য এবং আইনবহির্ভূত আচরণ। এতে আমাদের দণ্ডবিধি অনুসারে অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন এবং মানহানি অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেত।
অথচ এ ঘটনার পরও অনলাইনে কিছু মানুষের মধ্যে অশোভন আনন্দের প্রকাশ দেখা গেছে। তাঁরা খুশি, হিরো আলমের ‘উপযুক্ত’ শাস্তি হয়েছে বলে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছিলেন, বিকৃত গান তো আরও অনেকেই গান, পুলিশের পোশাক নাটক-সিনেমায় অনেকেই পরেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পুলিশের কি এটা করার সাহস হতো? এমন কেউ কেউ-দের সংখ্যা ছিল নগণ্য। ভদ্রসমাজের অনেকের মধ্যে বরং এই স্বস্তি ছিল যে এবার যদি থামে হিরো আলম!
২.
হিরো আলম তবু থামেননি। সর্বশেষে সংসদের উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে আমাদের এই ভদ্রসমাজের মানসিকতাকে আরও উন্মোচিত করেছেন তিনি। প্রথমে প্রার্থিতা বাতিলের মামলায় উচ্চ আদালতে জিতে প্রমাণ করেছেন, হিরো আলমদের বিরুদ্ধে কতটা অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে এই রাষ্ট্রযন্ত্র (জেলা ও নির্বাচন প্রশাসন)। উপনির্বাচনে একটি আসনে ঘোষিত ফলাফলে কয়েক শ ভোটে তিনি পরাজিত হন। হিরো আলম বলেছেন, বেশির ভাগ কেন্দ্রে তিনি জেতার পর হঠাৎ শেষ ১০ কেন্দ্রের ফলাফল জানানো বন্ধ করে তাঁকে মোট ভোটে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। একজন নির্বাচন কমিশনার অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর অভিযোগের ভিত্তি নেই। দেশের বর্তমান নির্বাচন সংস্কৃতি বিবেচনায় নিলে মনে হবে, নির্বাচন কমিশনারের কথার চেয়ে হিরো আলমের কথা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু আমরা শহরের শিক্ষিত সমাজ হিরো আলমের কথা বিশ্বাস করলেও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করব না প্রায় কেউই। বরং হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলব এটা ভেবে যে ভাগ্যিস জেতেনি হিরো আলম!
জীবনসংগ্রামের পাঠ থেকে শিক্ষা নেওয়া হিরো আলম জানেন এসব। তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার ডাকতে হবে। এ জন্য তাঁরা আমাকে মানতে চান না।’
আমরা কি সত্যিই তাঁর এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারব?
৩.
হিরো আলমের প্রতি সমাজের এলিট, পাতি–এলিট, স্বকল্পিত এলিটদের এমন মনোভাবের কারণ কী? আমার ধারণা, এটা সমাজের কণ্ঠহীন, অবয়বহীন আর ক্ষমতাহীন মানুষদের প্রতি আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছু নয়। হিরো আলম এমন সুবিধাবঞ্চিত সমাজ থেকে উঠে এসে তাঁর কণ্ঠ, চেহারা, এমনকি ক্ষমতা আমাদের দেখাতে পারছেন সদর্পে, এটা সহ্য হয় না আমাদের অনেকের।
আমরা বরং অভিযোগ করি, হিরো আলম রুচিহীন ও নিম্নমানের, তাঁর গান ও অভিনয় সহ্য করা যন্ত্রণাদায়ক। যদি এটি সত্যিও হয়, আমাদের ভেবে দেখা উচিত, তিনি কি তাঁর গান আর অভিনয় দেখতে বাধ্য করছেন আমাদের? তিনি কি কোনো বেসরকারি গণমাধ্যমের মালিকানা সূত্রে বা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ব্যবহার করে এসব করছেন? হিরো আলম নিজেই বলেন, তিনি বিখ্যাত হওয়ার জন্য এসব করেননি, করেছেন মানুষকে আনন্দ দিতে। সেই আনন্দ তাঁর ভক্তরা উপভোগ করলে আমাদের সমস্যা কী? সমাজের ওপরতলার যোগ্যতাহীন মানুষেরা যখন ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি-সংস্কৃতি বা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে অবাধ সুবিধা পান এবং আমাদেরকে বিরক্ত করেন, তাঁদের নিয়ে আমরা কি এতটা সমালোচনায়
মুখর হই?
হিরো আলম দেশের ইমেজের বারোটা বাজাচ্ছেন, এমন কথাও বলা হয়। তাঁকে দেখে নাকি বাংলাদেশ সম্পর্কে খারাপ ধারণা হবে আন্তর্জাতিক বিশ্বের। এসব যাঁরা বলেন, তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন যে দেশের ইমেজের ক্ষতি হয় আসলে কী কারণে? এটি হয় গুম-খুন-নির্যাতন, কেন্দ্রীয় ব্যাক থেকে রিজার্ভ চুরি, নির্বাচনে কারচুপি, লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার আর জীবিকার খোঁজে গিয়ে অসহায় মানুষের ভূমধ্যসাগর আর বনে–জঙ্গলে করুণ মৃত্যুর সংবাদে। দেশের ইমেজের এসব ক্ষতির জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের সঙ্গে ফেসবুকে সগৌরবে ছবি দিয়ে হিরো আলমকে গালমন্দ করেন, এমন মানুষ অনেকে আছেন এ সমাজে। অথচ তাঁর সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ রয়েছে, সেখানে কৌতূহল, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া অন্য কিছু দেখা যাবে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
হিরো আলমের স্বতঃস্ফূর্ততা আর সাহসকে কেউ কেউ ঔদ্ধত্যও ভাবেন। আরও অনেকে অনেক কিছু ভাবেন তাঁকে নিয়ে। বছর তিনেক আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর আহ্বান জানিয়ে হিরো আলম একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে সম্ভবত এসব লোকের উদ্দেশেই তিনি লিখেছেন, ‘সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোক হইল ভীতু। নিজেরা তো কিছু করবেই না, কাউকে করতে দেখলেও গা জ্বলে।’ তিনি লিখেছেন, ‘আমি সকল বিধবা মা, পরিত্যক্ত নারী ও শিশুদের জন্য সংস্থা করে যেতে চাই, যাতে আমার মায়ের মতো কারও মায়ের যেন মাইর খেয়ে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে রাত কাটানো না লাগে!’
এমন মহৎ স্বপ্ন কজন দেখি আমরা, কজনের আছে এমন মানবিক বিবেচনাবোধ?
হিরো আলম উপনির্বাচনের ফলাফল মেনে নেননি। তিনি উচ্চ আদালতে নির্বাচনী কারচুপির কাগজপত্র নিয়ে যাবেন বলেছেন। যদি তিনি সুবিচার পান সেখানে, আমাদের কথিত ভদ্রসমাজ আর জেলা প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা হবে তা। দেশের সংসদে যোগ্যতাহীন ও দায়িত্বহীন যে সংসদ সদস্যরা আছেন, তাঁদের জন্য উপযুক্ত অস্বস্তি তৈরি করতে পারবেন তিনি। তাঁকে নির্মম অপমান করা পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য অসামান্য এক পোয়েটিক জাস্টিসের উদাহরণও হতে পারে এটি।
হিরো আলমের আয়নায় আমাদের অনেকের নেতিবাচক মানসিকতা ও আচরণের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। নিজের ক্রমাগত উত্থানের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিমধ্যে তাঁদের বহুভাবে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। তিনি উচ্চ আদালতে মামলা করার সুযোগ পেলে, সেখানে প্রতিকার পেলে, এর ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
সেটি যদি না–ও হয়, হিরো আলম এ দেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য অদম্য আইকন হয়েই থাকবেন। আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, আমরা মুক্তিযুদ্ধটা করেছিলাম এই মানুষদের বিকশিত হওয়ার সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য। তাঁদের নিগৃহীত, অপমানিত করার জন্য বা বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘দাবায়া’ রাখার জন্য নয়।
-
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
আরএএস